আচ্ছা,
৮১ বছর বয়সে সাধারণত মানুষ কী করে
?
ঘর ভরে থাকে নাতি-নাতনিতে। তাদের খাওয়া হলো কি না দেখা,
তাদের সঙ্গে গল্প করা,
তাদের রূপকথার দেশে নিয়ে যাওয়া আর
শিশুতোষ ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে শান্তি বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া।
সেই বয়সেই কিনা গোলসিয়ার খাতুন বসে গেলেন পরীক্ষার টেবিলে
!
সাতটি সন্তান তাঁর। বড় ছেলে শফিকুল ইসলাম পূবালী ব্যাংকের
ডিজিএম হয়ে এরই মধ্যে অবসরও নিয়ে ফেলেছেন। অন্য
ছেলেমেয়েরাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং ছেলেমেয়ের সুখ-দুঃখ
ভাগ করে নিয়েই জীবনের শেষ কটা দিন তিনি পার করে দিতে
পারতেন। কিন্তু তাঁর মনে তো রয়েছে পড়াশোনার ইচ্ছা
!
বাবার
বাড়ি ঝিনাইদহের চাকলাপাড়ায়। বাবা কাজী আব্দুর রশিদ।
রক্ষণশীল আর পীরভক্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় পড়াশোনা করতে
পারেননি গোলসিয়ার খাতুন। এরপর বিয়ে। ১৯৪৭ সালে জেলার
দেবীগঞ্জ উপজেলার খোঁচাবাড়ি গ্রামের নওফেল উদ্দিন
প্রধানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের ১৩ বছর পর তিনি
প্রাইভেটে এসএসসি পাস করেন ১৯৬০ সালে। এরই মধ্যে পরিবারে
আসতে থাকে সন্তানেরা। তারপর যা হয়। আমাদের দেশের প্রায়
প্রতিটি নারীর জীবনই এর পর থেকে আবর্তিত হয় হেঁসেল-খাবার
ঘর ঘিরে। সবার দিকে নজর রাখতে রাখতেই একসময় দেখা যায়,
বেলা
যে পড়ে এল...
গোলসিয়ার খাতুনের জীবনটাও সেভাবে কেটে যেতে পারত। কিন্তু
তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁকে নিয়ে এসেছে পরীক্ষার হলে। দেবীগঞ্জ
উপজেলার খোঁচাবাড়ি গ্রামের এই নারী বেছে নিয়েছেন বাংলা,
ইংরেজি,
অর্থনীতি,
ইসলাম শিক্ষা আর সমাজবিজ্ঞান। পরীক্ষার
আগে নিয়মিত ক্লাসও করেছেন।
কেন হঠাৎ পড়াশোনায় মন
?
গোলসিয়ার খাতুন বলেন,
জ্ঞানের আলো
দিয়ে মনের অন্ধকার দুর করার জন্যই পড়াশোনা করছেন তিনি।
বাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতেন স্কুল-কলেজগামী
শিক্ষার্থীদের। ভাবতেন,
আহা
!
যদি আমিও লেখাপড়া করতে পারতাম
!
এরপর ঠিক করেন এ যুগের ছেলেমেয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই
পড়াশোনা করবেন। সেভাবেই তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
১৬ জানুয়ারি বিকেলে ছিল অর্থনীতি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা।
বিকেল চারটায় পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখা গেল,
তিনি লিখেই
চলেছেন। হাত এতটুকু কাঁপছে না। ডানে-বাঁয়ে তাকানোর কোনো
ফুরসত নেই তাঁর। এখনো তিনি চশমা ছাড়াই দেখতে পান।
গোলসিয়ার খাতুনের বিষয়ে জানতে চাই দেবীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের
অধ্যক্ষ মো. আনিছুর রহমানের কাছে।
"ইচ্ছা থাকলে যেকোনো বয়সে
পড়াশোনা করা সম্ভব। কোনো সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য নয়,
একমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্যই তিনি এ বয়সে পড়াশোনা করছেন।
অবাক লাগে এই বয়সে তিনি পড়াশোনা করছেন,
পরীক্ষা দিচ্ছেন
! "−বললেন
তিনি।
পরীক্ষা কক্ষের ইনভিজিলেটর শ্যামল বরণ রায় জানান,
গোলসিয়ার
খাতুন প্রশ্নপত্র পেয়েই লেখা শুরু করে দেন। কোনো দিকে
তাকান না। এই বয়সে পড়াশোনা আর পরীক্ষা দিয়ে তিনি দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছেন। ইংরেজির শিক্ষক মোমেন আলী জানান,
তিনি
নিয়মিত ক্লাস করতেন। শেখার অদম্য ইচ্ছা আছে তাঁর।
কথা বলি গোলসিয়ার খাতুনের ছোট ছেলে ফজলে রশিদের সঙ্গে।
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন তিনি। ফিরে এসে গ্রামে কৃষিজমি
দেখাশোনা করেন। তিনি বললেন,
"মায়ের ইচ্ছার প্রতি আমাদের
পূর্ণ সমর্থন আছে।"
ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ে। পরীক্ষা শেষ। হল থেকে বেরিয়ে আসেন
গোলসিয়ার খাতুন। কথা বলেন আমাদের সঙ্গে। একগাল হেসে বলেন,
"২০০৬ সালে উন্নুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। প্রথম বর্ষ
শেষ করে ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। ভালোই দিয়েছি। ইংরেজি-বাংলা
ভালো দিয়েছি। ইসলাম শিক্ষা আর সমাজবিজ্ঞান পরীক্ষা বাকি আছে।
উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,
"আরবি নিয়ে পড়ব,
আর গান শিখব।"
গান
?
বললেন,
গান করতে ভালো লাগে। আধ্যাত্মিক আর প্যাথেটিক
গান বেশি ভালো লাগে। কেন বেদনার গানের প্রতি আকর্ষণ
?
এ প্রশ্নের উত্তর দেন না গোলসিয়ার খাতুন। ভালো লাগে মানে
ভালো লাগে,
এর আবার ব্যাখ্যা
কী
?
যিনি এই বয়সে এইচএসসি
পরীক্ষা দিচ্ছেন,
তাঁর জীবনে যে আরও অনেক চমক থাকবে,
সে ব্যাপারে কি সন্দেহ আছে
? |